অনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা (Proportional Representation বা PR)
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন একটি পদ্ধতি যেখানে ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন বণ্টন করা হয়। এটি কিছু দেশে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বাড়াতে সহায়ক হয়েছে, আবার কোথাও সরকার গঠনে জটিলতা তৈরি করেছে।

Table of Contents
নির্বাচনে বিজয়ী দলের আসনসংখ্যা যদি জনগণের মোট ভোটের অনুপাতে বিতরণ হয়, তাকেই বলে অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা Proportional Representation (PR) ব্যবস্থা। এই পদ্ধতিতে কোনও দল মোট ভোটের ৩০% পেলে সংসদে প্রায় ৩০% আসন পাবে – অর্থাৎ ভোটের অনুপাতে আসন দেওয়া হয়। এর ফলে বেশিরভাগ ভোটারের মতামত সংসদে প্রতিফলিত হয় এবং খুব কম ভোট নষ্ট যায়। বর্তমানে বিশ্বের অনেকগুলো দেশে (প্রায় ৯৩টি দেশে) ভিন্ন ভিন্ন ধরনের PR ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী নেপাল ও শ্রীলঙ্কাসহ ইউরোপ, আফ্রিকার বহু দেশ ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরনের PR পদ্ধতি দেখা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতিতে যে দল আসন-সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তারাই সরকার গঠন করে – এতে প্রায়শই দেখা যায় কোনো দল মোট ভোটের তুলনায় অনেক বেশি আসন পেয়ে যায় এবং বিপুল ভোটপ্রাপ্ত অন্য দলগুলো কম আসনে সীমিত থেকে যায়। অনুপাতিক পদ্ধতিতে এই বৈষম্য অনেকটাই কমে আসে। নিম্নে আমরা PR নির্বাচনী পদ্ধতির প্রধান কয়েকটি ধরন, এদের উদাহরণ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করবো।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রধান ধরনসমূহ
অনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কয়েকটি প্রচলিত রূপ রয়েছে। এর মধ্যে পার্টি-তালিকা PR, মিশ্র-সদস্য আনুপাতিক PR এবং একক স্থানান্তরযোগ্য ভোট (Single Transferable Vote) উল্লেখযোগ্য। নিচে এসব পদ্ধতি সহজ ভাষায় বর্ণনা করা হলো এবং কোন কোন দেশে সেগুলো ব্যবহৃত হয় তা উদাহরণসহ উল্লেখ করা হয়েছে।
পার্টি-তালিকা পদ্ধতি
Party-List PR
এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ভোটাররা সরাসরি কোনো প্রার্থীর নামে ভোট না দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের তালিকাকে ভোট দেন। প্রতিটি দল নির্বাচনের আগে একটি প্রার্থীর তালিকা প্রস্তুত করে। নির্বাচনে প্রত্যেক দলের মোট প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুযায়ী সংসদে তাদের আসন ভাগ করে দেওয়া হয়। যেমন ধরুন, সংসদে ২০০টি আসন; যদি দল A ২৫% ভোট পায়, তবে তারা প্রায় ৫০টি আসন পাবে, দল B এর ১৫% ভোটের জন্য প্রায় ৩০টি আসন ইত্যাদি। তালিকা থেকে ক্রমানুসারে সেই দলের প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। অনেক দেশে পুরো দেশকে একযোগে একটি তালিকা ধরে আসন বণ্টন হয়, আবার কিছু দেশে অঞ্চলভিত্তিক আলাদা তালিকা থাকে। বন্ধ-তালিকা (Closed list) পদ্ধতিতে ভোটার শুধু দল নির্বাচন করেন, প্রার্থী তালিকার ক্রম ঠিক করে দল নিজেই; আর উন্মুক্ত তালিকা (Open list) পদ্ধতিতে ভোটাররা দলের পাশাপাশি পছন্দের প্রার্থীকেও তালিকা থেকে চিহ্নিত করতে পারেন। ইউরোপের বহু সংসদীয় গণতন্ত্র (যেমন নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, স্পেন), লাতিন আমেরিকার দেশগুলো (যেমন ব্রাজিল) ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো নবগঠিত গণতন্ত্রে এই পার্টি-লিস্ট পদ্ধতি বহুল প্রচলিত। বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসন আসলে পার্টি-তালিকা পদ্ধতিতেই বণ্টিত হয় – প্রতিটি দল তাদের সংসদে জেতা আসনের অনুপাতে কয়েকজন নারী সদস্য মনোনীত করে থাকে।
মিশ্র-সদস্য আনুপাতিক পদ্ধতি
Mixed-Member Proportional
মিশ্র-সদস্য আনুপাতিক পদ্ধতি হলো এমন এক ব্যবস্থা যেখানে ঐতিহ্যবাহী FPTP ও অনুপাতিক তালিকা ভোট একসাথে মিলিয়ে ফলাফল নির্ধারণ করা হয়। এতে সাধারণত ভোটারদের দুইটি ভোট থাকে: এক ভোট এলাকার সরাসরি প্রার্থীর জন্য (যেমন আমাদের বর্তমান ব্যবস্থার মতো) এবং আরেক ভোট একটি দলের জন্য। দেশের মোট আসনের একটি অংশ সরাসরি নির্বাচিত সদস্য (সংসদীয় আসনভিত্তিক) দিয়ে পূরণ হয়, বাকী অংশ দলগুলোর মোট ভোটের অনুপাতে সংযোজনী আসন হিসাবে বণ্টন করা হয়। এভাবে দ্বিতীয় ভোটের মাধ্যমে দলগুলোকে অতিরিক্ত আসন দিয়ে মোট আসনসংখ্যা ভোটের শতাংশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন সংসদে ৩০০টির মধ্যে ১৫০ আসন সরাসরি নির্বাচিত হবে এবং অবশিষ্ট ১৫০ আসন দলভিত্তিক তালিকা অনুযায়ী বণ্টন হবে। যদি কোনো দল সরাসরি আসনে কম জেতে কিন্তু মোট ভোট বেশি পায়, তবে তালিকা আসন দিয়ে সেটি পুষিয়ে নেওয়া হবে যাতে সর্বমোট তারা ভোটের অনুপাতে আসন পায়। এই পদ্ধতি প্রথম চালু হয়েছিল জার্মানিতে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর) এবং পরে নিউজিল্যান্ড এটিকে গ্রহণ করেছে। এছাড়াও স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের আঞ্চলিক সংসদ, বলিভিয়া ও লেসোথোর মতো দেশেও MMP পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। মিশ্র পদ্ধতির বড় সুবিধা হলো এটি দ্বৈত লক্ষ্য পূরণ করে: একদিকে সমগ্র সংসদের আনুপাতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়, অন্যদিকে প্রত্যেক এলাকার জন্য আলাদা প্রতিনিধিও থাকে। তবে এ ব্যবস্থা বিশ্বে তুলনামূলক কম দেশেই চালু (শুধু ৭টি দেশে সম্পূর্ণ MMP ব্যবস্থার প্রয়োগ আছে বলে উল্লেখ করা হয়)।
একক স্থানান্তরযোগ্য ভোট
Single Transferable Vote
STV একটি অনুপাতিক পদ্ধতি যেখানে ভোটাররা প্রার্থীদের পছন্দক্রম (১, ২, ৩...) অনুযায়ী র্যাঙ্ক করেন। এখানে কোনও দলীয় তালিকা বাধ্যতামূলক নয়; প্রার্থীরা নিজ নামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং একটি বড় এলাকার একাধিক (ধরুন ৩-৭ জন) প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। STV ভোট গণনার সময় ধাপে ধাপে ভোট স্থানান্তর করা হয়: যদি আপনার প্রথম পছন্দ প্রার্থী খুব কম ভোট পান এবং জেতার সুযোগ না থাকে, তাহলে আপনার ভোটটি পরবর্তী পছন্দের প্রার্থীর ঝুলিতে যোগ হয়। আবার কোনো প্রার্থী জয়ের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ভোট পেয়ে ফেললে, তার অতিরিক্ত ভোটও পরবর্তী পছন্দগুলোর প্রার্থীদের মাঝে ভাগ হয়ে যায়। এভাবে একাধিক রাউন্ড গণনা শেষে区域র জনগণের বেশিাংশ কোনো না কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি পান, খুব কম ভোটই নষ্ট হয়। STV পদ্ধতিতে দলের চেয়ে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ, ফলে এটি দলে ভাঙন ছাড়াই অনুপাতিক ফল দেয়। আয়ারল্যান্ড ও মাল্টা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় নির্বাচনে STV ব্যবহার করছে এবং অস্ট্রেলিয়ার সংসদের উচ্চকক্ষ (সেনেট) ও ভারতের রাজ্যসভা নির্বাচনেও STV পদ্ধতি অনুসৃত হয়। STV ব্যবহার করলে ভোট গণনা কিছুটা জটিল হলেও এর মাধ্যমে প্রতি এলাকাতেই ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।
আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার সুবিধাবলী
অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুফল রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরিলক্ষিত। নিচে PR ব্যবস্থার কিছু সাধারণ সুবিধা উদাহরণসহ তুলে ধরা হলো:
- ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ ফলাফল: PR ব্যবস্থায় কোন দল মোট ভোটের যত শতাংশ পায়, তাদের সংসদে আসন প্রায় সেই অনুপাতে মেলে। এতে ভোটারদের ইচ্ছার সঠিক প্রতিফলন ঘটে এবং বড় দলগুলো অতিরিক্ত আসন-বোনাস পেয়ে ছোট দলগুলোর প্রতি অন্যায় সুবিধা পায় না। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে ২০২۴ সালের নির্বাচনে মাত্র ৩৩.৭% ভোট পেয়ে একটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করেছিল, যা PR পদ্ধতিতে সম্ভব হতো না। তাই PR ফলাফলকে জনগণের প্রকৃত ভোটের আনুপাতিক nearer করে “ভোটের মূল্য সমান” নীতিতে অবিচল থাকে।
- বেশি ভোটার প্রতিনিধিত্ব ও কম “নষ্ট ভোট”: যেহেতু PR-এ প্রায় সব ভোটই কোনো না কোনো আসনের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাই খুব কম ভোটই বৃথা যায়। ভোটাররা জানেন যে তাঁদের ভোট মূল্যহীন হবে না, ফলে ভোটদানে উৎসাহ বাড়ে এবং ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। উদাহরণ হিসাবে, যুক্তরাজ্যের ২০১৯ নির্বাচনে FPTP-এর কারণে ২ কোটি ২০ লাখেরও বেশি (৭০% এর বেশি) ভোট সংসদে প্রতিনিধিত্ব পায়নি। PR পদ্ধতিতে এমন “নষ্ট ভোট” থাকে না, তাই জনগণ নির্বাচনে বেশি সম্পৃক্ত বোধ করে এবং অংশগ্রহণও বাড়ে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
- ছোট দল ও সংখ্যালঘু মতের প্রতিনিধিত্ব: PR একটি বহুদলীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করে যেখানে ছোট বা নবগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোও কিছু আসন পেতে পারে। এতে সংসদে মতের বৈচিত্র্য বাড়ে এবং জাতির নানা অংশের (আঞ্চলিক, ধর্মীয়, জাতিগত, ইত্যাদি) সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরও উঠে আসার সুযোগ পায়। উদাহরণস্বরূপ, নিউজিল্যান্ড ১৯৯৬ সালে PR ব্যবস্থা (MMP) গ্রহণের পর থেকে সংসদে মাওরি, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসীসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অতীতে সংসদে স্থান না পাওয়া ছোট দলগুলোও আসন পেয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন PR চালু করলে বিভিন্ন অঞ্চলে উপেক্ষিত ভোটারগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ত, যেখানে বর্তমানে একটি দলের সামান্য অগ্রগামিতেই পুরো এলাকার শতভাগ আসন পেয়ে যায়।
- বৃহত্তর নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব: অনুপাতিক পদ্ধতিতে দলগুলো তালিকা প্রার্থীদের মনোনয়নের সময় বিভিন্ন পেশা, লিঙ্গ ও সম্প্রদায়ের মানুষকে স্থান দিতে উদ্বুদ্ধ হয়, যাতে ভোট আকর্ষণ করা যায়। ফলে নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন ও নির্বাচিত হওয়ার হার PR ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে PR বা মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণকারী দেশগুলোতে গড়ে প্রায় ২৯% সংসদ সদস্য নারী ছিলেন, বিপরীতে FPTP বহাল দেশগুলোতে সে হার মাত্র ~২২%। এর একটি কারণ হলো PR ব্যবস্থায় একাধিক আসনের বড় নির্বাচনী এলাকা থাকে যেখানে প্রতিটি দলে একাধিক প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ থাকে – দলগুলো একাধিক নারীকে প্রার্থী তালিকায় রাখতে পারে এবং কোটার বিধান থাকলে তা কার্যকর করাও সহজ হয়। এতে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সমাজের বিভিন্ন অংশের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়।
- কম রাজনীতিক বিভাজন ও কম মেরুকরণ: PR পদ্ধতিতে সাধারণত একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না, বরং জোট সরকার গঠন করতে হয়, যার ফলে নীতিনির্ধারণে বিভিন্ন দলের মধ্যে সমঝোতা ও সহযোগিতা করতে হয়। সরকার গঠনের জন্য মাঝামাঝি অবস্থানের দলগুলো একত্রে কাজ করতে বাধ্য হওয়ায়, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন এতে চরমপন্থী অবস্থানের প্রভাব হ্রাস পায় ও মধ্যপন্থী নীতি প্রাধান্য পায়। উদাহরণসরূপ, জার্মানিতে দীর্ঘদিন ধরে মধ্য-বাম ও মধ্য-ডান দলগুলোর সমন্বয়ে জোট সরকার চলছে, ফলে নীতিমালায় ভারসাম্য রক্ষা হয়েছে। বিপরীতে FPTP পদ্ধতি অনেক সময় দুইদলীয় কাঠামো তৈরি করে যা সমাজে মেরুকরণ বাড়াতে পারে। PR ব্যবস্থায় অধিকাংশ ভোটারের কোনো না কোনো প্রতিনিধি থাকায় রাজনৈতিক অসন্তোষ ও বিভাজন কিছুটা কম হয় বলে ধারণা করা হয়।
- জেরিম্যান্ডারিং ও নির্বাচনী কারচুপি প্রতিরোধ: FPTP পদ্ধতিতে ভোটের ভাগ্য নির্ভর করে একেকটি ছোট আসনের সীমানার উপর, যা জেরিম্যান্ডারিং (ইচ্ছাকৃতভাবে সীমানা বদলে সুবিধা নেওয়া) এর সুযোগ দেয়। কিন্তু PR ব্যবস্থায় প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকা বড় (বহু-সদস্য বিশিষ্ট) হওয়ায় সীমানা আঁকাবাঁকা করে তেমন সুবিধা পাওয়া যায় না। গবেষণায় দেখা গেছে, ৫ আসনবিশিষ্ট বা তার বেশি সদস্যপদ-যুক্ত বড় এলাকায় জেরিম্যান্ডারিং কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া PR-এ ভোট কেন্দ্রিভাবে তালিকা অনুযায়ী গণনা হয়, ফলে স্থানীয় পর্যায়ে কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জালভোট প্রভৃতির সুযোগও কমে যায় বলে অনেকের মত। প্রোপোরশনাল সিস্টেমে দলীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় তালিকার মাধ্যমে মনোনয়ন ও ফল নির্ধারিত হয়, তাই ভোটকেন্দ্র কেন্দ্রিক সহিংসতা ও অতিরিক্ত অর্থব্যয়ের প্রবণতাও হ্রাস পেতে পারে।
আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাব্য সমস্যা
যদিও PR ব্যবস্থার অনেক সুফল রয়েছে, বাস্তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জ এবং অসুবিধাও আছে যা সমালোচকরা তুলে ধরেন। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া কিছু সীমাবদ্ধতা নিচে আলোচনা করা হলো:
জোট সরকার ও অস্থিরতা
অনুপাতিক পদ্ধতিতে অধিকাংশ সময় কোনও একক দল সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না, বরং একাধিক ছোট দলের জোটে সরকার গঠন করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে এই জোট টেকসই না-ও হতে পারে, ফলে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন বা আগাম নির্বাচনের প্রয়োজন পড়তে পারে। উদাহরণ হিসেবে, ইতালিতে ঐতিহ্যগতভাবে PR জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় গত অর্ধশতকে প্রচুর স্বল্পমেয়াদী জোট সরকার হয়েছে, যদিও ইতালি পরবর্তীতে পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে। আবার ইসরায়েল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারবার নির্বাচন হয়েছে, কারণ ছোট ছোট দলের সমর্থন ব্যতীত কোনো বড় দল সরকার গঠন করতে পারেনি। তাই সমালোচকদের মতে PR ব্যবস্থা সরকারকে স্থিতিশীলতার চেয়ে আপসের ওপর বেশি নির্ভরশীল করে তোলে।
ছোট দলের অতিরিক্ত প্রভাব ও “কিং-মেকার” ভূমিকা
জোট সরকারে কোনো ছোট দল যদি সরকার গঠনের জন্য অত্যাবশ্যক হয়, তবে তারা নিজ আসন সংখ্যা অপেক্ষা বেশি প্রভাব বা দাবিদাওয়া আদায় করতে পারে। ফলে খুব অল্পসংখ্যক ভোটারের পছন্দের কোনো দলও সরকারে থেকে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা পেয়ে যায়, যা জনমতের মূল স্রোতকে সম্পূর্ণ প্রতিফলিত নাও করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলে মাত্র কয়েকটি আসন-পাওয়া ধর্মীয় দলগুলি জোট সরকারে প্রয়োজনীয় হওয়ায় নীতিগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (যেমন শিক্ষা বা পরিবার আইন) নিজের মত অনুসারে নির্ধারণের চাপ দিতে পেরেছে – যা মোট ভোটারের খুব স্বল্প অংশ চেয়েছিল। এ ধরনের পরিস্থিতিকে সমালোচকরা “জিম্মি অবস্থা” বলে আখ্যা দেন।
চরমপন্থী বা অপ্রচলিত দলের প্রবেশ
PR পদ্ধতিতে ভোটের অনুপাতে আসন দেওয়া হয় বলে অত্যন্ত অল্প ভোট পেলেও কিছু দল আসন পেয়ে যেতে পারে (যদি কোনও ন্যূনতম ভোট-Threshold খুব বেশি না থাকে)। এতে চরমপন্থী, জাতীয়তাবাদী বা অন্য বিতর্কিত মতাদর্শের ছোট ছোট দলও পার্লামেন্টে জায়গা পেতে পারে। যেমন, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে খুব খাটো সংখ্যক ভোট পেয়েও উগ্র-ডানপন্থী ও উগ্র-বামপন্থী দলগুলো সংসদে প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। যুক্তরাজ্যে ২০১৫ সালের নির্বাচনে যদি PR ব্যবস্থা থাকত, তবে মাত্র ১৩% ভোট পেয়ে ইউকিপ (UKIP) পার্টি পার্লামেন্টে ৮৩টি আসন পেত, যেখানে FPTP-এ তারা মাত্র ১টি আসন পেয়েছিল – ফলে এক ধরণের উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য সংসদে অনেক বড় জায়গা পেত। এ কারণে অনেকেই আশঙ্কা করেন PR চালু করলে সম্প্রীতি বিরোধী বা গণতান্ত্রিক চেতনার বিরোধী দলসমূহও জনপ্রতিনিধিত্বের সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। অবশ্য অনেক দেশে এ সমস্যা সামাধানে ৪%-৫% ভোটের প্রাথমিক Threshold নির্ধারণ করা হয় (যেমন জার্মানিতে ৫%) যাতে একেবারে ক্ষুদ্র দলগুলো আসন না পায়।
নিজ এলাকার সরাসরি প্রতিনিধিত্বের দুর্বলতা
সম্পূর্ণ পার্টি-তালিকা ভিত্তিক PR পদ্ধতিতে ভোটারদের নিজেদের এলাকার জন্য সরাসরি নির্বাচিত এমপি থাকে না। একজন সংসদ সদস্য পুরো দেশের ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় তিনি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের প্রতি সরাসরি জবাবদিহি অনুভব নাও করতে পারেন – কারণ তার নির্বাচিত হওয়া নির্ভর করে দলের মোট ভোটের ওপর, নির্দিষ্ট আসনের ভোটারের ওপর নয়। এতে স্থানীয় সমস্যা বা চাহিদাগুলো উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অবশ্য মিশ্র-সদস্য পদ্ধতি বা STV এই সমস্যা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে, কারণ সেখানে আংশিকভাবে এলাকার এমপি বা বড় জেলার একাধিক এমপি থাকে। তবু যারা সরাসরি এলাকার প্রতিনিধি পছন্দ করেন, তারা মনে করতে পারেন PR পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধিদের জনগণের কাছাকাছি থাকার বিষয়টি কমে যাবে।
দলীয় তালিকা ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের প্রশ্ন
পার্টি-লিস্ট PR ক্ষেত্রে কোন প্রার্থী সংসদে যাবেন তা দলীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করে (বিশেষ করে বন্ধ-তালিকা পদ্ধতিতে)। এতে আশঙ্কা রয়েছে যে বড় দলের শীর্ষ নেতা-কর্মীরা তালিকায় উপরের দিকে থাকবেন, আর তৃণমূলের নবীন বা যোগ্য কিন্তু অপ্রতিষ্ঠিত নেতারা পিছিয়ে পড়বেন। বাংলাদেশে যেমন পরিবারতন্ত্র বা অর্থবান প্রার্থীর প্রভাব রাজনীতিতে অভিযোগ শোনা যায়, PR তালিকাতেও দলপতি তাঁর পছন্দের মানুষদের উপরে স্থান দেবেন – জনসাধারণ সরাসরি প্রার্থী বেছে নিতে পারবেন না। তাছাড়া তালিকা প্রকাশ আগে থেকে করলে দলীয় কোন্দল ও লবিং বাড়তে পারে, আবার আগে থেকে তালিকা প্রকাশ না করলে স্বচ্ছতার অভাব থাকবে, যা ভোটারদের মধ্যে অবিশ্বাস জন্মাতে পারে। অর্থাৎ, PR চালু হলে ভোটারদের চেয়ে দলীয় প্রধানদের হাতে সিদ্ধান্ত更多 থাকবে বলে সমালোচনা আছে। তাই দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত না থাকলে PR পদ্ধতিতে যোগ্য প্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি বা দুর্নীতিরও আশঙ্কা থাকে বলে অনেকে মনে করেন।
কাঠামোগত পরিবর্তনের জটিলতা
দীর্ঘদিন FPTP ব্যবস্থায় অভ্যস্ত কোনো দেশে হঠাৎ PR ব্যবস্থা চালু করা সহজ নয়। এতে সংবিধান সংশোধনসহ নানাবিধ আইনি পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন নিয়মে ভোটদান ও মনোনয়ন প্রক্রিয়ার সাথে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। অনেক সময় বড় দলগুলো – যাদের FPTP-এ লাভ হয়েছে – তারা এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করে, ফলে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জন করাও কঠিন হয়। উদাহরণত, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে PR নিয়ে আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত বড় দলগুলোর অসম্মতিতে পদ্ধতি বদলায়নি। অতএব PR এর নীতি ভালো হলেও বাস্তবায়নে জনমত ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা জোগাড় করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে PR: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ বর্তমানে ব্রিটিশ ‘ওয়েস্টমিনস্টার’ ধাঁচের একক আসন সংখ্যাগরিষ্ঠ (FPTP) নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করছে, যেখানে জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের প্রত্যেকটিতে পৃথক ভোটে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনি নির্বাচিত হন। এ পদ্ধতিতে বিজয়ী প্রার্থীর প্রতিনিধিত্বে কেবল তার ভোটাররা আসেন, বাকি ভোটাররা সেই আসনে কোন প্রতিনিধি পান না। বিগত নির্বাচনী ফলাফলগুলোতে আমরা বহুবার লক্ষ্য করেছি যে দেশে প্রধান দুটি দলের প্রাপ্ত মোট ভোট প্রায় সমান হলেও আসন-বণ্টনে বিরাট gap হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (BNP) মোট ভোটের প্রায় ৪১% পেয়ে ৩০০টির মধ্যে ১৯০টি আসনে জেতে, বিপরীতে আওয়ামী লীগ প্রায় সমপরিমাণ ৪০% ভোট পেয়েও পায় মাত্র ৬২টি আসন। অর্থাৎ অর্ধেকের কাছাকাছি জনগণ ভোট দিয়ে মাত্র পাঁচভাগের একভাগ আসনে প্রতিনিধি পেয়েছিল। FPTP পদ্ধতির এই বৈষম্য অনেকেই অন্যায্য মনে করেন এবং আনুপাতিক ব্যবস্থা চালুর voice বাংলাদেশে জোরালো হয়েছে।
বাংলাদেশে PR চালুর পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ছোট ও নবগঠিত বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল (যেমন জামায়াতে ইসলামী, কমিউনিস্ট পার্টি, গনঅধিকার পরিষদ, জাতীয় পার্টির মতো দলগুলো) দৃশ্যত PR ব্যবস্থার দাবিতে সোচ্চার, কারণ এতে তাদের জন্য সংসদে কিছু আসন পাওয়ার সুযোগ বাড়বে। তাদের যুক্তি, PR পদ্ধতি এলে আর কোনো ভোটার সম্পূর্ণ বঞ্চিত হবেন না – যে দল বা প্রার্থী ভোট পান, সেই অনুপাতে আসন পাবেন বলে দেশের মোট জনগণের মতামতের প্রতিফলন সংসদে আসবে। উপরন্তু PR এলে প্রতিটি ভোট পার্থক্যপূর্ণ হয়ে ওঠায় নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ও পেশীশক্তির ব্যবহার কমবে এবং জোর-জবরদস্তিমূলক ভোট ডাকাতি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ইত্যাদি হানাহানি কমার সম্ভাবনা আছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। বাংলাদেশে প্রতি নির্বাচনের সময় যে সহিংসতা ও ভোট নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা যায়, PR পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে দলভিত্তিক ভোট হওয়ায় তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হবে বলে দাবি করা হয়। তাছাড়া বর্তমান ব্যবস্থায় একটি দল ভোটের এক চতুর্থাংশ পেয়েও আসনের পেয়ে সরকার গঠন করতে পারে, যেখানে PR থাকলে যে কোনও দলকে প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি ভোট পেতে হবে সরকার গঠনের জন্য – অর্থাৎ জনগণের আসল সমর্থন ছাড়া কেউ सत्ता আসতে পারবে না। এতে সরকার更多 জনমতের প্রতি জবাবদিহি থাকবে এবং এককদলীয় আধিপত্য কমে সহযোগিতামূলক রাজনীতি বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদীদের ধারণা।
বড় ও প্রতিষ্ঠিত দলগুলো – বিশেষ করে বিএনপি প্রকাশ্যে PR-এর বিরোধিতা করেছে এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও সন্দিহান (তাদের স্পষ্ট মতামত পাওয়া যায়নি)। বিরোধিতার কারণ হলো: বাংলাদেশে বহু বছর ধরে প্রচলিত FPTP পদ্ধতিতে দুইটি বৃহৎ দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং জনগণ এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। হঠাৎ PR চালু করলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় পরিবর্তন আসবে এবং কেমন ফল হবে তা অনিশ্চিত – এমন আশঙ্কা আছে। বিএনপির এক নেতা মন্তব্য করেছেন যে নির্বাচন ব্যবস্থা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে জড়িত এবং একে বদলাতে জনমতের সম্মতি দরকার; হঠাৎ PR ব্যবস্থা চাপিয়ে দিলে তা জনগণ মেনে নাও নিতে পারে। এছাড়া, PR এলে কোনো একক দল সহজে একার সরকার গঠন করতে পারবে না, যা বড় দলগুলোর জন্য সুবিধাজনক নয় কারণ তখন তাদের অন্য দলের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হবে। এ কারণে ক্ষমতাসীন বা বড় দলের নেতারা PR সমর্থনে অনাগ্রহী থাকতে পারেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে PR ব্যবস্থার সম্ভাব্য সুফল ও চ্যালেঞ্জ দুটোই রয়েছে। সুফলের মধ্যে রয়েছে – ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, হেরে যাওয়া দলের সমর্থকরাও কিছু প্রতিনিধিত্ব পাবেন বলে ফল মেনে নেওয়া শক্তিশালী হবে এবং হয়তো নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা বা বিরোধিতাও কমবে। অনেকেই মনে করেন, PR এলে একক দলের সর্বময় ক্ষমতা কমে গিয়ে আলোচনা ও জোটের সংস্কৃতি গড়ে উঠবে, যা বাংলাদেশের মত বিভাজিত রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। উদাহরণ হিসাবে, প্রতিবেশী নেপাল কয়েক বছর আগে সংসদে অনুপাতিক উপাদান যুক্ত করেছে এবং সেখানে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী বিভিন্ন দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব পেয়েছে, যা শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রে উত্তরণে সহায়ক হয়েছে। তেমনই বাংলাদেশেও বিভিন্ন ক্ষুদ্র দল ও স্বতন্ত্র মত যদি সংসদে জায়গা পায়, তবে অনেক উপেক্ষিত ইস্যু ও জনগোষ্ঠীর声音 রাষ্ট্রনীতিতে আসতে পারে বলে অনেকে আশা করেন।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলোও উপেক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো ক্ষমতা ভাগাভাগির তুলনায় বিজয়ী পক্ষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দিকে। PR এলে ঝুঁকি রয়েছে যে অসম জোট সরকারগুলো দুর্বল ও অস্থির হতে পারে, যেহেতু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম মানার রেওয়াজ এখনে খুব শক্তিশালী নয়। উদাহরণস্বরূপ, নেপালে অনুপাতিক মিশ্র পদ্ধতি চালুর পর সংসদে বহু ছোট দলের প্রবেশ ঘটেছে, যার ফলে সরকার গঠন ও সংবিধান সংশোধনে কয়েকবার তৈরি হয়েছে এবং “গভীর রাজনৈতিক” পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সংসদে ৮-১০টি দল থাকে এবং কেউ সুস্পষ্ট多数 না পায়, তবে আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখাও কঠিন হতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র দুর্বল; PR পদ্ধতিতে যদি দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রার্থী তালিকা নির্ধারণের পূর্ণ ক্ষমতা পায় তবে জনগণের চেয়ে দলনেতাদের প্রভাব আরও বেড়ে যেতে পারে এবং এর অপব্যবহারও হতে পারে। মানুষ যদি মনে করেন যে PR আসলে দলীয় প্রধানদের খেয়ালখুশি按旨 সংসদ সদস্য বানানোর রাস্তা, তবে এর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে।
আরেকটি চিন্তার বিষয় হল, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে PR চালুর সাথে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সম্ভাব্য প্রভাব। যেমন, দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতে ইসলামী বা অনুরূপ ধর্মীয় দলের আসন খুব কম ছিল বা তারা নিষিদ্ধ ছিল; PR এলে তারা শতাংশ ভোটের জোরে উল্লেখযোগ্য আসন পেতে পারে, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতেমাত্রা যোগ করবে। সমালোচকরা assume করেছেন যে জামায়াত হঠাৎ PR এর দাবিতে সোচ্চার হয়েছে, কিন্তু তাদের নিজস্ব রাজনীতিতে তারা কখনও সংখ্যালঘু, নারীর ইত্যাদি নিয়ে সোচ্চার ছিল না। ফলে疑问 উঠেছে, তারা আদৌ PR এর সুফলের জন্য না কি নিজেদের জন্য এটি চাইছে। একইসঙ্গে, PR ব্যবস্থায় ধর্মীয় বা আঞ্চলিক পরিচয়ের ছোট দলগুলো বেশি আসন পেলে রাজনৈতিক মেরুকরণ অন্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে – যেমন কেউ হয়তো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এজেন্ডা নিয়ে বাম কেন্দ্রিক এজেন্ডা নিয়ে সংসদে প্রভাব ফেলার সুযোগ পাবে। এসবই বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখে ভাবার বিষয়।
সংবিধান ও আইনগত বাধা আরেকটি বড় প্রশ্ন। সংবিধান অনুযায়ী আমাদের নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারিত, সেটি পরিবর্তন করতে সাংবিধানিক সংশোধন চাই। বর্তমানেও (২০২৫ সালে) দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে আছে বলে বলা হলেও, নির্বাচিত সংসদ ছাড়া সংবিধান বদলানো নৈতিকভাবে বিতর্কিত হবে। অতএব, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ও জনসমর্থন ছাড়া PR ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব নয়। BNP ও আওয়ামী লীগ – প্রধান দুই দল – যদি এতে একমত না হয়, তাহলে একতরফাভাবে PR চালু করলে সেটি ভবিষ্যতে গৃহীত হবে কি না সন্দেহ থেকে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, PR নিয়ে আলোচনার শুরুতেই各পক্ষের আস্থা ও consensus গড়ে তোলা জরুরি, নইলে আরো জটিল হয়ে পড়বে।
সব মিলিয়ে, অনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা বাংলাদেশে এক আকর্ষণীয় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এটি নৈতিকভাবে অধিকতর ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হলেও, আমাদের দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও সংস্কৃতিতে তা কীভাবে মানিয়ে নেওয়া যাবে – সে বিষয়ে পরিষ্কার দিকনির্দেশনা ও প্রস্তুতি দরকার। বিভিন্ন দেশে PR ব্যবস্থার উদাহরণ থেকে আমরা শিখতে পারি যে এটি সংসদে বেশি মতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করলেও শাসনব্যবস্থা জটিল করে তুলতে পারে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ আনতে পারে। আবার অন্য দিক থেকে চিন্তা করলে, বর্তমানে FPTP পদ্ধতির ত্রুটির (অনেক ভোটার প্রতিনিধিহীন থাকা, একদলীয় প্রাধান্য, নির্বাচনী সহিংসতা) নিরসনে PR হয়তো একটি সমাধান হতে পারে যদি আমরা সেটিকে সঠিকভাবে উপযোগী করে নিতে পারি।
অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা এক ধরনের ভোটের পদ্ধতি যেখানে ভোটের হার অনুযায়ী আসন দেওয়া হয়। এর প্রধান তিনটি ধরন আছে: দলভিত্তিক তালিকা পদ্ধতি, মিশ্র-সদস্য পদ্ধতি, ও একক স্থানান্তরযোগ্য ভোট পদ্ধতি – যেগুলো বিভিন্ন দেশে চলছে। PR ব্যবস্থার মাধ্যমে ছোট-বড় সকল দল তাদের প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব পায়, ফলে বেশি ন্যায়সংগত ফল হয় এবং জনমতের বহুমাত্রিক চিত্র সংসদে ফুটে ওঠে। এতে নারীদের অংশগ্রহণসহ সমাজের সব শ্রেণির আওয়াজ উঠে আসার সুযোগ বাড়ে, ভোটারদের ভোট কম নষ্ট হয় এবং তারা উৎসাহী থাকে কারণ জানে তাদের ভোটেও আসন নির্ধারিত হতে পারে। তবে PR চালু করলে জোট সরকার স্বাভাবিক হবে, যা একদিক থেকে সমঝোতার রাজনীতি শেখাবে বটে, কিন্তু স্থায়িত্ব ও দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণে কখনও问题 হতে পারে। বিদেশের উদাহরণে আমরা যেমন জার্মানি বা নিউজিল্যান্ডে PR-এর সুফল দেখি (ভোটের প্রতি সম্মান বৃদ্ধি, ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব), তেমনি ইতালি বা ইসরায়েলের例 উল্লেখ করে অনেকে এর চ্যালেঞ্জের কথা বলেন (খণ্ডিত সংসদ ও অতিরিক্ত ছোট দলের চাপ)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে PR ব্যবস্থা চালু করা মানে আমাদের পরিচিত নির্বাচনী পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন আনা। এটি যেমন স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের পথে একটি পদক্ষেপ হতে পারে, তেমনি এর সফল বাস্তবায়নের জন্য দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য, আইনগত সংশোধন এবং জনগণের আস্থা অর্জন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে উন্নত করতে এবং ভবিষ্যতে যেন প্রত্যেক ভোটার তার ভোটের মূল্য পায় – সেই লক্ষ্যে অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ইতিবাচক আলোচনার দরজা খোলা রাখা উচিত বলে অনেকে মনে করছেন। দিনশেষে, কোন নির্বাচন পদ্ধতি সর্বোত্তম তা নির্ভর করে একটি দেশের রাজনৈতিক প্রয়োজন, জনগণের সচেতনতা ও প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার উপর। আনুপাতিক ব্যবস্থা ম্যাজিক সমাধান নয়, তবে এটি একটি বিকল্প পথ যা বাংলাদেশের মত বহুজাতিক ও বহুমতের দেশে গণতন্ত্রকে আরও প্রতিনিধিত্বশীল ও ন্যায়সঙ্গত করতে সাহায্য করতে পারে – যদি আমরা সুচিন্তিতভাবে এর সুবিধা-অসুবিধাগুলো cân বিবেচনা করে বাস্তবায়ন করতে পারি।
তথ্যসূত্র: সংক্ষিপ্ততার জন্য এখানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় উৎসের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সূত্রগুলো হল: Protect Democracy-র গবেষণা নিবন্ধ, উইকিপিডিয়া ও বিশ্বজনমত জরিপের উপাত্ত, Electoral Reform Society ও FairVote-এর বিশ্লেষণ, এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে Prothom Alo ও The Geopolitics-এর সাম্প্রতিক আলোচনা। এসব উদাহরণ ও পরিসংখ্যানের মাধ্যমে PR ব্যবস্থার ধারণা ও প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি তোমরা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পেয়েছো এবং এটি বাংলাদেশে কীভাবে কাজে লাগতে পারে বা কী চ্যালেঞ্জ আনতে পারে তা বুঝতে পেরেছো। গণতন্ত্র সম্পর্কে জানার পথে এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন – ভিন্ন পদ্ধতির ভাল-মন্দ দু’দিক বুঝে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা এবং সচেতন নাগরিক হয়ে ওঠা।